মুফিজুর স্বপন : স্বাধীনতা তৃতীয় বর্ষে এসে ১৯৭৫ সালের ১৫'ই আগস্ট কালরাত্রিতে সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাঙলার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আপৎকালীন সময়ে বাঙালি জাতি এই হত্যাকান্ডের বিচার হতে বঞ্চিত হয়েছিলো, হত্যার বিচার বন্ধে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ক্রীড়নক সরকার খন্দকার মোশতাক।
অধ্যাদেশ সংযুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত, পিছনের কলাকুশলী অথবা পরিকল্পনায় যুক্ত কারো বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা করা যাবে না। এমন কি সুপ্রিমকোর্ট কিংবা কোর্টমার্শালেও তাদের বিচারের ব্যবস্থা রহিত করা হয়। অফিসে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পথও রুদ্ধ করা হয় অধ্যাদেশে। জিয়াউর রহমান হীন স্বার্থে বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত বিচারপ্রাপ্তির মৌলিক অধিকারটিকে খর্ব করে আদেশটিকে আইনে পরিণত করে। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংসদে পাশ করা হয় মানবতাবিরোধী ইনডেমনিটি আইন। দেশে শুরু হয় বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি। শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হয় খুনিদের।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট নয় দিনের মাথায় সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। ইনডেমনিটি মোশতাকের করা অধ্যাদেশ বলা হলেও নেপথ্যে ছিলো জিয়াউর রহমান, তাই তো সংসদে তার দল বিএনপি অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করে বাংলার ইতিহাসে লজ্জাজনক ইতিহাসের জন্ম দেয়।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনত সিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দুজনকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রদূত করা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে নিয়োগ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু জায়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অনুরোধে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যার তদন্ত কমিশন গঠিত হলে এর সদস্য হিসাবে নিয়োগ পান থমাস উলিয়ামস কিউসি এমপি, মি. ছিন ম্যাকব্রাইড এসসি, মি. জেফরে থমাস কিউসি এমপি এবং মি. এ্যাবরে রোজ। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, সে বিষয়ে তদন্ত করতে চেয়েছিলো এ কমিশন। কমিশনের সদস্যরা এ বিষয়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করেন। তারা ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং যথারীতি ভিসার জন্য লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে আবেদন করেন। তদন্ত কমিশনকে ভিসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় হাইকমিশন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানানো হয় যে, জিয়াউর রহমান সরকার তাদের ভিসা দিতে রাজি নয়।
তদন্ত কমিশন ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সের কমিটিকক্ষে সভা করে সংবাদ সম্মেলন করে। কমিশনের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের প্রকাশ্যে দায় স্বীকার, তাদের নির্বিঘ্নে দেশের বাইরে পাঠানোর মধ্যস্থতাকারীদের থেকে সংগৃহীত তথ্য এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের সমন্বয়ে ৫ নভেম্বর গঠিত জেলহত্যা তদন্ত কমিশনের অকার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত হন।
একইসাথে আত্মস্বীকৃত খুনিদের ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়ার গেজেট থেকেও তারা তথ্য পান। তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার তদন্ত করতে দিতে চায়নি এবং খুনিদের সুরক্ষা দেওয়াসহ পুরস্কৃত করেছিলো।
আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ১২'ই নভেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। খুলে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকণ্ডে বিচারের পথ। বাঙালি জাতি সুযোগ পায় ইতিহাসের কলঙ্ক মুক্ত হওয়ার।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
