মুফিজুর স্বপন :
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে ;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে—আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে !
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস—
আকাশের ওপারে আকাশ।
জীবনানন্দ দাসের উল্লেখিত কবিতাটির প্রথম নাম 'আকাশলীনা' ছিলো না। প্রথমে ছিলো 'ও হৈমন্তিকা' শিরোনামে।।একটা সময় পরে কবি নিজেই নাম পরিবর্তন করেছেন।প্রথম লাইনটিও ছিল-'ও হৈমন্তিকা, অইখানে যেও নাকো তুমি।' পরে আবার পরিবর্তন করে তিনি লিখেন"সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, কবিতার সম্পূর্ণ নতুন নাম দেন তিনি-'আকাশলীনা।' মজার বিষয় হচ্ছে, কবি শিরোনামটি কবিতার কোথাও উল্লেখ'ই করেননি।
প্রথম স্তবকের একদম শুরুতেই কবি কবিতার নারীটির নাম দিয়েছেন 'সুরঞ্জনা।' কেন তিনি তাকে ফিরে আসতে অনুনয় করছেন। আবেগ বা বিচারবোধের কথা ধরলে যে কারো ভুল করার অবকাশ থাকে। বয়েসের বিলাপ কথাটা তো চালু আছেই। যুবক চরিত্রটি সরাসরি পরিণত বয়সকে মিন করেনা কারণ তরুণ বয়সটি ম্যাচিউর কিছুকে তুলে ধরে। সুরণ্ঞ্জনাকে যদি যুবতী ধরা হয় তাহলে কবিতার 'যুবক' চরিত্রের সাথে সংযোগ ঘটাতে সুবিধা হয়। যুবকের সাথে অভিন্ন মিশে যাওয়ার আগে যুবতীটিকে ভাবতে হবে এখানে কি হতে যাচ্ছে তার দ্বারা,সর্বোপরি তার সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা। ভালোমন্দের ব্যবধানে গুরুত্ব দিতে হবে। 'কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে' এ পঙতিতে প্রথমত 'তাহার' সম্বোধনে যুবকটি সুরঞ্জনার কাছে তখনো পর্যন্ত আগন্তু- অপরিচিত তাই 'তাহার' বলা হয়েছে আর 'তার' সম্বোধন কারণ ততক্ষণে যুবকটি সুরণ্ঞ্জনার অতি পরিচিত এবং তাদের মধ্যবর্তী আবরণ উবে গেছে। সেখানে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা সে (সুঞ্জনা) জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে । তাই 'ফিরে এসো মাঠে, ঢেউয়ে, ফিরে এসো হৃদয়ে আমার' মূলত চিরন্তন প্রকৃতির আহবান। প্রকৃতি মানুষকে সুন্দরের মুখাপেক্ষী করে তাই সুরঞ্জনাকে জীবনের নান্দনিক দিকে আহবান করানো হচ্ছে। 'মৃত্তিকার মতো তুমি আজ/তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে' এ দুটি লাইনে আছে এরপরের জাগতিক বাস্তবতা । গভীর একটা জীবনবোধ । মাটির বুক আলগা করে যে ঘাস জন্ম নেয় সেভাবেই যুবকের প্রেমের (যেকোনো দিক থেকে হতে পারে) বীজ যুবতী সুরঞ্জনার মধ্যে বড় হতে পারে বা জন্ম নিতে পারে যেটা তার জন্য আনতে পারে নির্মম উপলব্ধি । সেই 'ঘাস'-এর নতুন বীজটিকে ঘিরে তাকে বরণ করতে হতে পারে অসহায় নিঃসঙ্গতা,রূঢ়ভাব সামাজিকতা। 'বাতাসের ওপারে বাতাস/আকাশের ওপারে আকাশ' লাইন দুটিতে সেই অসীম জগৎকে বোঝানো যা মূলত মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুরঞ্জনার দুর্বিষহ পরিণতি বা নিঃসঙ্গতা তাকে নিশ্চিত এক যাত্রায় ঠেলে দিবে। 'আকাশলীনা' নামটি এ দুটি পঙতির উদৃতিতে সার্থকতা পায় কারণ বাতাসের অবস্থান তো মহাশূন্য আকাশেই এবং সেখানেই সুরঞ্জনার মতো অনেকের স্বপ্ন নিমিষেই বিলীন হয়ে যেতে পারে।
যারা মনে করেন এটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বা কবির দাম্পত্য কলহের একটা অনুলিখন এটা খুব সাদামাটা দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায়। কারণ কবিতাটির গভীরতার দিকে নজর দিলে এটাকে একটা বয়সের জন্য দেয়া সতর্কবার্তা, সচেতন বক্তব্য মনে হয় কবির দিক থেকে।
কবিতার চরম গভিরতা হচ্ছে ধাঁধা তৈরি করা বা আড়াল রেখে যাওয়া। যতজন পাঠক কবিতা পড়বে একান্ত নিজের কল্পতরু একটা ব্যক্তিগত অবলোকন তৈরি করে নিতে পারবে, তারপরেও কোনো না কোনো অব্যক্ত ব্যাখ্যা থেকে যাবে। আবার একজনের অবলোকন অনেক সময় অন্য অনেকজনের একান্ত দৃষ্টিপাতের সাথে হুবহু মিলে যায়, অনেকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তখন কবিতা ব্যক্তিক দেয়াল ভেঙে সামগ্রিক অর্থে চলে যায়। এ দিকটি মাথায় রেখেই 'আকাশলীনা'-র আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করলাম।
